– মুহাম্মাদ আব্দুল আউয়াল।।
সম্প্রতি আমি বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ইসলামিক স্কলার এর লেখা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর “রওযা মুবারক যিয়ারত ও মদীনা মুনাওয়ারার ফজিলত” সম্পর্কে একটি কিতাব পাঠ করছিলাম, যিনি বাংলাদেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন। লেখক কিতাবের শুরুতে প্রচ্ছদে বড় বড় অক্ষরে লিখেছেন- “বিশ্বনবী_(স.)”!!! এবং ইনারে অসংখ্য অগণিত জায়গায় ‘বিশ্বনবী’ এবং দরূদ শরীফের সংক্ষেপরূপ ‘(স.)’ লেখা হয়েছে। অথচ কিতাবটির ছাপতে গিয়ে লেখক সৌন্দর্য বর্ধনের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছে এবং হাদিয়াও লিখেছেন যথেষ্ট! সুতরাং বুঝাই যায় লেখক জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই দরূদ শরীফের সংক্ষেপরূপ (স.) লিখেছেন এবং কৃপণতা করেছেন!
সাইয়্যেদুল মুরসালিন, সাফিউল মুযনাবিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন, রাহতুল আশিকিন, হাবিবে মুকাররম, নূরে মুযাসসাম হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ক্ষেত্রে “বিশ্বনবী” বলা তাঁর শান ও আযমতকে খাঁটো করার সামিল মনে করি। বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিল, সভা-সেমিনারে কিংবা লেখনিতে এক শ্রেণির আলেম সমাজ নবীজীর অসংখ্য গুণবাচক নাম মুবারক থাকার পরও “বিশ্বনবী” বলেন ও লিখেন।
#বিশ্বনবী_বলা_বা_লেখা
১) আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেছেন- ‘আমি আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’- সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭
পাঠকবৃন্দ লক্ষ্য করুন! আল্লাহ্ তা’য়ালা ‘রাব্বুল আলামিন’ আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। সুতরাং বুঝা গেল, আল্লাহ্ তা’য়ালা যার ‘রব’, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য ‘রহমত’। বিশ্বনবী বলার মাধ্যমে নবীজীকে এই বিশ্ব তথা পৃথিবীর জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়।
কবি নজরুল খুব সুন্দর বলেছেন-
ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মাদ
এলোরে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস
দেখবি যদি আয়।
কবি নজরুল আমাদের নবীজী কে পৃথিবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেননি। তিনি ত্রিভুবন অর্থাৎ উপরের জগৎ, নিচের জগৎ ও মধ্য জগৎ তথা এই দুনিয়ার মধ্যে প্রিয় বলেছেন।
যারা ‘বিশ্বনবী’ বলা বা লিখার বিষয়ে তর্ক করে বলেন- অসুবিধা কি? আমি বলবো আপনারা কিছু শব্দের অর্থের দিকে লক্ষ্য করুন-
* বিশ্ব নবী
* বিশ্ব কবি
* বিশ্ব নন্দিত
* বিশ্ব কোষ
* বিশ্ব যুদ্ধ
* বিশ্ববিদ্যালয়
* বিশ্বসাহিত্য
এই শব্দগুলো দিয়ে সাধারণত পৃথিবীর পরিধি, জ্ঞান-বিজ্ঞানকেই বুঝায় বা সীমাবদ্ধ করে। অথচ আমাদের জানার বাইরে দৃশ্য ও অদৃশ্য অনেক সৃষ্টি রয়েছে সেসব সৃষ্টির জন্যেও নবীজী #নবী ও #রহমত। সুতরাং যারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শানে কথায় কথায় ‘বিশ্বনবী’ বলেন বা লিখেন তাদেরকে আরো সতর্ক হওয়া জরুরী। কারণ, বিশ্বনবী শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শান ও আযমত হ্রাস পায় বা সীমাবদ্ধ করা হয় বলে মনে করি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
অনেকেই বলেন- #আমার_নবী #তোমার_নবী ইত্যাদি শব্দতো অহরহই ব্যবহার করা হয়। তাহলে ‘বিশ্বনবী’ বললে সমস্যা হবে কেন? ভাইজান, ‘আমার নবী’ শব্দ যখন নবীজী দিকে সম্পর্ক করে ব্যবহার করা হয় তখন একান্ত আপন ভেবে, ভালোবেসে প্রয়োগ করা হয়।
যেমন আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন-
১) “পড়ুন আপনার প্রভুর নামে।”- সূরা আলাক।
২) “আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেননি।”- সূরা দ্বোহা।
লক্ষ্য করুন, আল্লাহ্ তা’য়ালা আমাদের সকলের রব হয়েও নবীজীর ক্ষেত্রে একান্ত করে মহব্বত করে বলেছেন ‘আপনার রব’। এটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আর ‘বিশ্বনবী’ বলা সঙ্কীর্ণতা। সুতরাং ‘আমার নবী’ আর ‘বিশ্বনবী’ বলার মাঝে পার্থক্য অনেক। আমার নবী শুধু বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নয় বরং সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।
অনেকে ‘বিশ্বব্রহ্মান্ড’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করে ‘বিশ্বনবী’ জায়েজ করার চেষ্টা করেন। আমি বলি তাহলে ‘বিশ্বব্রহ্মান্ডের নবী’ বলতে ক্ষতি কি! শুধু বিশ্বনবী বলার দরকার কি!
#দরূদ_শরীফ_সংক্ষেপ_করা
দরূদ শরীফ সংক্ষেপে লেখার ব্যাপারে হাদীস শরীফ ও সম্মানিত আলেমগণের কঠোর হুশিয়ারী রয়েছে। হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম মুবারকের সাথে দরূদ শরীফ লিখতে ও পাঠ করতে সংক্ষেপ করা সমীচিন নয়। অজ্ঞতা বশতঃ করলে ভিন্ন কথা। কিন্তু কোন আলেম হযরত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দরূদ শরীফ সংক্ষেপে লিখেন তাহলে আলেমের উপর কঠোর ফতুয়া বর্তাবে। বিশেষ করে, এই কম্পিউটারের যুগে দরূদ শরীফ সংক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই।
#দলিল
১) আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেছেন- ‘এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’- সুরা : আলাম নাশরাহ্, আয়াত : ০৪
২) হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- “যে ব্যক্তি আঁমার উপর সালাত বা দরূদ শরীফ লিখবে, সর্বদাই আঁমার নাম মুবারকের সাথে ঐ লিখায় পূর্ণ দরূদ শরীফ লিখবে।– মু’জামুল কবির, ইমাম তাবরানী
* ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন- “যে ব্যক্তি দরূদ শরীফকে প্রথম সংক্ষেপে করেছিল তার হাত কর্তন করা হয়েছে।”- তাদরীবুর রাওয়ী
* আল্লামা সৈয়দ তাহত্বাভী রাহমাতুল্লাহী আলাইহি দুররুল মুখতার এর হাশিয়ায় বলেছেন- ফাতোয়ায়ে তাতারখানীয়া থেকে বর্ণিত- “যে ব্যক্তি ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ কে সংক্ষেপে ‘সা.’ লিখে তাকে কাফির বলা হবে। কেননা তা হেয় করা আর নবীদেরকে হেয় করা ‘কুফরী’।
অনেকে বলে থাকেন- কাগজ, কালি, সময় ও খরচ সাশ্রয় করার জন্য দরূদ শরীফ সংক্ষেপে লেখা হয়। আমি বলবো- যার উসিলায় সব কিছু পেলাম তাঁর নাম মুবারকের সাথে দরূদ শরীফ লিখতে কাগজ, কালি, সময় ও খরচ সাশ্রয়ের হিসাব করা কৃপণতা নয় কি?
হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘প্রকৃত কৃপণ সেই ব্যক্তি, যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না।’- সুনানে তিরমিজি শরীফ
দরূদ শরীফ পাঠ করা ও লেখা উভয়ই অনেক অনেক ফজিলতপূর্ণ। দরূদ শরীফ পাঠে যেমন সংক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই তেমনি লিখতেও সংক্ষেপ করার সুযোগ নেই। সুতরাং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম মুবারকের পাশে দরূদ শরীফ লিখতে তাই পরিপূর্ণ লেখাটাই হচ্ছে সুন্নাহ। দরূদ শরীফ লিখতে যারা সংক্ষেপ করে তারাই প্রকৃত অর্থে কৃপণ।
উল্লেখ্য যে, যারা বিশ্বনবী বলা ও সংক্ষেপে দরূদ শরীফ লেখার পক্ষে কথা বলেন দয়া করে সাবলিল ভাষায় যথাযথ দলিল উপস্থাপন করুন। কেউ অযথা বিতর্কে জড়াবেন না এবং ফতুয়াবাজী করা থেকে বিরত থাকুন।
আল্লাহ্ তা’য়ালা আমাদের সকলকে বিষয়গুলো বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
বিনীত,
মুহাম্মাদ্ আব্দুল আউয়াল
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ইং
বিঃদ্রঃ (লেখকের ফেইসবুক টাইম লাইন থেকে নেয়া)।