প্রভাত সংবাদ ডেস্ক : লতাকস্তুরী একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। তবে এ গাছের পরিপক্ব টাটকা বীজ হাতে নিয়ে একটু ঘষা দিলেই চমৎকার ঘ্রাণ ভেসে আসে। হয়তো সেজন্যই কস্তুরী নামকরণ হয়েছে। দেখতে ঢেঁড়সের চেয়ে অনেক শক্ত এবং ঋজু। তবে ছায়াচ্ছন্ন স্থানে জন্মালে এর এই ঋজু ভাবটা আমূল পাল্টে গিয়ে গাছটি প্রচুর শাখাবিশিষ্ট প্রায় লতানো হয়ে আসে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চল, ভারতের হুগলি, দাক্ষিণাত্য, কর্নাটকের পাহাড়ি এলাকা, হিমালয়ের পাদদেশ, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, জাভায় বুনো হিসাবে প্রচুর জন্মে।
অন্যান্য নাম:
বাংলাদেশে এটি লতাকস্তুরী নামে পরিচিত হলেও এর আরও অনেক নাম আছে যেমন- আয়ুর্বেদের ভাষায় কটুকা, লতাকস্তুরিকা; হিন্দি- মুসকদানা, মুসকডিদি; তামিল কটক- কস্তুরী; আরবী-হরুলমুস্ক; ফারসি- মুফদানা; ইংরেজি- Musk seeds, Ambrette seeds. বৈজ্ঞানিক নাম: Abelmoschus moschatus Medic (Synonym- Hibiscus abelinoschus Linn.) গোত্র- মালভেসী।
লতাকস্তুরী গুল্মের বর্ণনা:
লতাকস্তুরী গুল্ম বর্ষজীবী বা দ্বিবর্ষজীবী। এদের কাণ্ড, পাতার বোঁটা, ফলের গায়ে প্রচুর সূক্ষ্ম কাঁটা থাকে। পাতা বহুরূপী, নিচেরগুলো ডিম্বাকৃতি, সূক্ষ্মাগ্র এবং উপরেরগুলো করতলাকৃতি, ৩-৭ খণ্ডে উপখণ্ডিত। ফুল উজ্জ্বল হলুদ, পাপড়ি ঢেঁড়সের মতো হলেও বেশ পুরু ভেলভেটের মতো এবং বড়। সাধারণত এক বোটায় একটি ফুল বা কখনও একাধিক ফুল হয়। ফল ঢেঁড়সের মতো, তবে অপেক্ষাকৃত বেঁটে ও মোটা এবং শক্ত রোমাবৃত। প্রতি ফলে ৫০ থেকে ৬০ বা তারও কিছু অধিক সংখ্যক বীজ থাকে। বীজ শক্ত, কালচে- খয়েরি রঙের, প্রায় বৃক্কাকৃতি। গাছ ঘন হয়ে জন্মালে প্রায়ই কোনো শাখা হয় না, কিন্তু একটু ফাঁকা জায়গায় হলে গোড়া থেকেই প্রায় প্রতিটি পর্বে ডাল হতে পারে এবং ১০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে দেখা যায়। প্রতি গাছে ৬০-১০০টি ফল হয়। ফুল ও ফল ভাদ্র-পৌষ মাস হয়।
লতাকস্তুরী-এর বীজের গুণাগুণ:
লতাকস্তুরীর বীজ ওষুধে ব্যবহার করা হয়। লতাকস্তুরীর ব্যবহার অতিপ্রাচীন না হলেও প্রাচীন, এ সম্পর্কে সন্দেহ নেই। লতাকস্তুরী তিক্তমধুর রস, শুক্রবর্ধক, শীতবীর্য, লঘুপাক, চোখের জন্য হিতকর, ছেদক, শ্লেষ্মঘ্ন, তৃষ্ণানাশক, বস্তিগতরোগ নাশক ও মুখরোগ নাশক। বাংলাদেশ জাতীয় আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারী ১৯৯২-তে সাতটি ওষুধে লতাকস্তুরী ব্যবহারের উল্লেখ দেখা যায়।
লতাকস্তুরীর বীজকে বাণিজ্যিকভাবে এমব্রেটে বীজ বলা হয়। এ বীজের খোসা থেকে একপ্রকার উপকারী তেল পাওয়া যায়; যাকে ‘মাস্কবীজ তেল’ বা ‘এমব্রেটে বীজ তেল’ বলা হয়। এ তেল শক্তিশালী, অদ্ভুত এবং স্থায়ী কস্তুরীর গন্ধবিশিষ্ট। এ তেলের প্রধান উপাদান হলো মেসকিটারপিন অ্যালকোহল-ফার্ণেসল।
লতাকস্তুরী-এর উপকারিতা:
এছাড়াও চিকিৎসা শাস্ত্রসমূহের দৃষ্টিতে লতাকস্তুরীর ভূমিকা অনেক। এবার দেখা যাক লতাকস্তুরী ব্যবহার করে কোন কোন সমস্যায় সরাসরি উপকার পাওয়া যায়-
১. শ্লেমাজনিত মাথা ব্যথা সারাতে: বর্ষা বা বৃষ্টির পানিতে ভিজে, ঠাণ্ডা লাগলে বা পেট গরমের কারণে মাথা ও বুকে শ্লেষ্ম জমে মাথা ব্যথা বা মাথাধরলে ১০ থেকে ১৫টি লতাকস্তুরী গাছ-এর বীজ একটু গরম পানি সহযোগে বেটে অল্প পানিতে মিশিয়ে ১ বার বা ২ বার খেলে ঐ শ্লেষ্মবিকার থাকবে না।
২. পেটফাঁপা: একই নিয়মে পেটফাঁপা ও ক্লান্তি দূর করতে খেলে নিরাময় হয়। ক্লান্তির ক্ষেত্রে ঐ রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে নিলে অধিক উপকার হয়।
৩. শুক্রাল্পতায়: দেহসম্ভোগের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শুক্রাল্পতা বা ইন্দ্রিয়দৌর্বল্যের জন্য মন মতো আঙ্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিজের কাছেই ধিক্কার লাগে। এ অবস্থায় বীজ চূর্ণ ৩০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় মাখন-মিছরি সহযোগে প্রত্যহ দুবার করে কয়েকদিন খেলে ঐ অসুবিধা চলে যাবে। ইন্দ্রিয়শৈথিল্যের জন্য এর কাঁচা ও কচি ফল ঢেঁড়সের মতো রান্না করে খেলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়।
৪. হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা দূর করতে: হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা অনুভূত হলে এর বীজ ১৫ থেকে ২০টি পরিমানে নিয়ে থেঁতলিয়ে এক কাপের চার ভাগের একভাগ ঈষদুষ্ণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে সে পানিটা খেলে উপকার হয়।
৫. মুখের ভেতরের রোগ সারাতে: দাঁতের গোঁড়া ফোলা, মুখে দুর্গন্ধ হওয়া, ভিতরে হেজে যাওয়া, ঢোক গিলতে ব্যথা লাগা প্রভৃতি মুখের রোগের লক্ষণ। এ সমস্যায় ১৫ থেকে ২০টি বীজ থেঁতলিয়ে আধকাপ গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে ঐ পানি দিয়ে ভালোভাবে গড়গড়া করলে উপকার হয়। গড়গড়া করার সময় পানিটা কিছুক্ষণ মুখের ভিতর ধরে রাখলে উপকার অধিক এবং দ্রুত হয়। প্রাচীন কবিরাজবৃন্দ অবশ্য লতাকস্তুরী গাছ-এর বীজচূর্ণ অল্প ঘিয়ের সঙ্গে মিশিয়ে মুখের ভেতর লাগানোর পরামর্শ দেন।
৬. চোখের সমস্যা দূর করতে: চোখে ঝাপসা দেখা, পিচুটি পড়া, করকর করা, পানি পড়া, চোখ টনটন করা ইত্যাদি সমস্যায় লতাকস্তুরীর ২০ থেকে ২৫টি বীজ বেটে ৩-৪ চামচ পানিতে গুলিয়ে ভালোভাবে ছেঁকে শিশিতে রেখে দিতে হবে। তারপরে ঐ পানি দুবার চোখে ফোঁটা হিসাবে দিলে উপকার হবে। একবার বাটা বীজ মেশানো পানি ২ দিনের অধিক ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং ভালোভাবে সিদ্ধ করা পানি বিশুদ্ধ অবস্থায় এবং পরিচ্ছন্ন অবস্থায় বাটার কাজ সারতে হবে। ফোঁটা সরাসরি চোখে না দিয়ে একটি নরম অণুজীবমুক্ত কাপড় ডুবিয়ে যে পানি কাপড়ে উঠে আসবে তা সহ কাপড়টি চোখের উপর চেপে ধরলেও চলবে।
সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্রঃ রোদ্দুরে।