ভেষজ ডেস্ক : মাজা-ভাঙ্গা সাপের ফণা তোলার মত আপনার গত যৌবনের ফোঁসফোঁসানি একালেও অসহায়ের মত আপনাকে মন্ত্রকষ্ট কি পেতে হচ্ছে না? না হবে না?
তাই তাে মুনিদের প্রেসক্রিপ্সন ছিল—এক বলকা দুধ, বালা স্ত্রী , আর ভেষজটির সেবন এইগুলিই ছিল সে যুগের ন্যাচারাল,ভিটামিন আর হরমােন।
এইবার তাদের হিতোপদেশ শুনুন, দেহের বল একদিক থেকে আসে না, আর একভাবে ক্ষয়ও হয় না এবং একভাবে ধরেও রাখা যায় না।
বুদ্ধিমান সর্বদাই মনে রাখেন—যেমন নগর রক্ষার ভার নগরপালের, আর রথ চালনার ভার রথীর, সেইরকম এই দেহকে রক্ষা এবং সুরক্ষিত করার ভার দেহীর।
মােটকথা—দেহবল, মেধাবল ও মনােবলকে নিরুপদ্রবে রক্ষা করার চাবিকাঠি রয়েছে দেহীর হাতে। বল যে কি জিনিস, সেটা অম্বয় করে বলা যায় না, ব্যতিরেকেই বােঝা যায়—যেমন দাঁতের গুরুত্বটা উপলদ্ধি হয়, যখন সেটা পড়ে যায়। এতক্ষণ দেহরাজ্যের অনুশাসন পর্ব চললাে, এইবার আলােচনা করা যাক। বলা বা বেড়েলার ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে।
বলা বা বেড়েলা মালভেসি পরিবারের সিডা (Sida) গণের একটি সপুষ্পক গুল্ম। এই গণে প্রায় ২৫০টির বেশি প্রজাতি আছে। ভারতে অনেকগুলো পাওয়া যায় এবং সবগুলোই ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে যেসব উদ্ভিদের পাতা পশমময় এবং আকার হৃদযন্ত্রের মতো, সেগুলোর কার্যকারিতা বেশি। সাদা ফুলের গাছকে বলা হয় শ্বেত বেড়েলা (বৈজ্ঞানিক নাম: Sida cordifolia) এবং হলুদ ফুলের গাছকে বলা হয় পীত বেড়েলা (বৈজ্ঞানিক নাম: Sida rhombifolia)। এর রয়েছে নানা ঔষধি গুণ, যেমনঃ-
১. অপুষ্টিজনিত কার্শ্য রোগ: অপুষ্টির কারণে শরীর যেখানে শুকিয়ে যাচ্ছে বা কৃশ হচ্ছে অথবা দূর্বল হচ্ছে, সেখানে পীতপুষ্প বেড়েলার মূলের চূর্ণ দেড় গ্রাম বা ১৫০০ মিলিগ্রাম মাত্রায় ধারোষ্ণ দুধ আধা কাপ ও একটু মিছরির গুড়া মিশিয়ে দু’বেলা খেতে হবে।
২. উরঃক্ষতে: কোনো কারণে অকস্মাৎ বুকে আঘাত লেগে রক্ত উঠছে, সেক্ষেত্রে পীতপুষ্প বেড়েলার মূল ৫ গ্রাম নিয়ে জল দিয়ে বেটে একটু দুধ মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। প্রথম দিন তিন বার, পরে দিন থেকে প্রতিদিন ২ বার করে খেতে হবে। এটাতে উরঃক্ষত সেরে যাবে।
৩. আবাহুক রোগ: হাত ঘোরানো যায় না, পুরোপুরি উঁচু করাও যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে দু’রকম ফসলের সাদা এবং হলুদ বেড়েলা মূল ১৫ থেকে ২০ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে প্রতিদিন একবার করে খেতে হবে; তবে সিদ্ধ করার পূর্বে একটু ভিজিয়ে রেখে থেঁতো করে সিদ্ধ করতে হবে। যদি সাদা ফুলের গাছ জোগাড় না হয়, তাহলে হলুদ ফুলের বেড়েলা গাছের মূল নিতে হবে।
৪. রক্তপিত্ত: এই রোগের ক্ষেত্রে ২০ গ্রাম বেড়েলার সমগ্র গাছকে ক্বাথ করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আধা কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে রাখতে হবে, তবে মূলাংশ বেশি থাকলে ভালো হয়, তারপর এক কাপ দুধ ঐ ক্বাথ মিশিয়ে একটু গরম করে ওটা খেতে হবে। এইভাবে দুধ ক্বাথের সাথে মিশিয়ে কিছুদিন খেলে ওটা সমস্যা সেরে যাবে।
৫. রক্তার্শে: সে বহিবর্লি হোক আর অন্তবর্লি হোক, পীত বেড়েলার মূল ১০ থেকে ১২ গ্রাম একটু থেঁতো করে নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেই ক্বাথে খই চূর্ণ মিশিয়ে অথবা খই ভিজিয়ে খেতে হবে। এটা ব্যবহার করলে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আরও কিছুদিন খেলে অর্শের বর্লিটাও চুপসে যাবে।
৬. বাতরক্তে: রোগটা খুবই কঠিন, এটা শরীরের কোনো অংশকে বিকৃত (deformation) করতে পারে অথবা সঙ্কুচিত করতে পারে। এক্ষেত্রে বেড়েলার মূল ২০ গ্রাম ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেই ক্বাথ খেতে হবে। আর বেড়েলার ক্বাথ দিয়ে তৈরী তেল যাকে বেড়েলার তেল বলে; সে তেল সর্বাঙ্গে মালিশ করতে হবে।
৭. স্বরভঙ্গ: যেখানে রসবহ স্রোত বিকারগ্রস্ত হয়ে স্বরভঙ্গ হয়, সে স্বরভঙ্গ সেরে যায়; কিন্তু যে স্বরভঙ্গ ক্ষয়রোগ থেকে আসে, যেমন যক্ষ্মার স্বরভঙ্গ এ স্বরভঙ্গটি রোগ না। সারলে সারবে না, সুতরাং উপরিউক্ত কারণে যে স্বরভঙ্গ হবে, সেক্ষেত্রে বেড়েলা মূলের ছাল আধ গ্রাম মাত্রায় নিয়ে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে, সারাদিনে ৫ থেকে ৭ বারে একটু একটু করে চেটে খেতে হয়। এই রকম দুই তিন দিন খেলে ওটা প্রশমিত হবে।
৮. হৃদযন্ত্রের বিবৃদ্ধি (Dilated heart): এরা অল্প খেলেই ভালো থাকেন, একটা জোরে চললেই হাঁপাতে থাকেন, দৌড়ানো তো দূরের কথা, এই ক্ষেত্রে শ্বেত বেড়েলার মূলের ছাল চূর্ণ আধ গ্রাম মাত্রায় সকালে ও বিকাল আধা কাপ অল্প গরম দুধের সঙ্গে খেতে হয়, ২ থেকে ৪ দিন খেলেই রুগী বিশেষ উপকারিতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
৯. মূত্রকৃচ্ছ্রতা: মেদস্বী লোক প্রস্রাব করতে গেলে কষ্ট হয়, দাঁড়িয়েও সরলভাবে প্রস্রাব হচ্ছে না, যেন ভেতর থেকে একটা বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, এ বাধাটা কিন্তু রসবহ স্রোতে বায়ুবিকার; এক্ষেত্রে বেড়েলার বা পীতপুষ্প মূল
১০ গ্রাম একটু থেঁতো করে ২ কাপ জলে সিদ্ধ করে, এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সেই ক্বাথটা সকালে অর্ধেক ও বিকালে অর্ধেকটা খেতে হবে, এর দ্বারা ঐ কৃচ্ছ্রতার কিছুটা উপশম হবে।
১০. শ্বেত ও রক্তপ্রদরে: এই রোগে শ্বেত বা পীত বেড়েলার প্রয়োগের ক্ষেত্রটি হলো যেসব মায়েদের অগ্নিবল কম, পুষ্টিকর কিছু খেয়ে হজম করারও সামর্থ্য নেই, অথচ তাঁদের সাদা বা রক্ত স্রাবে, এছাড়াও এ রোগের নাম শ্বেতপ্রদর বা রক্ত প্রদর, এক্ষেত্রে বেড়ালার মূলে ১০ গ্রাম একটু থেঁতো করে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে, এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে, সকালের দিকে আধা কাপ দুধে মিশিয়ে তার অর্ধেকটা আর বাকী অর্ধেকটা বিকালের দিকে দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা তাঁর শরীরের বলাধান ফিরে আসবে এবং রোগেরও উপশম হবে।
১১. ফোড়ায়: যে ফোড়া উঠতে দেরী, পাকতে দেরী ও ফাটতে দেরী হয়, এমনকি বসাতেও দেরী হয়; মোটকথা এই ফোড়া মাংস ও মেদবহল জায়গায় ওঠে, তখন বেড়েলার মূল ও সেটা যদি সাদা ফুলের হয় ভালো হয় তা বেঁটে প্রলেপ দিলে ওর দাহ ও ব্যথা কমে যাবে, আর বসে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকলে বসে যাবে, নইলে ওটা পেকে ফেটে যাবে।
তথ্যসূত্রঃ আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রচার্য রচিত,
‘চিরঞ্জীব বনৌষধি।