শিশির সমরাট।। প্রকৃতির রূপ, কালের রূপ, দেহের রূপ, বয়সের রুপ, কোথায় না রুপের প্রশস্তি;কিন্তু ভূষণে ভূষিত না হলেও যে সবারই দৃষ্টি ও মনকে টানে সেও তাে রূপ। হয়তােবা রুপের আসল ব্যাখ্যা তাই; এই যে কমল, তারও সমাদর ওই রুপের জন্য, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—পদ্মের কি শুধুই রূপ? নাকি ওকে রুপক করার জন্যই তার রূপের প্রশস্তি; কিন্তু এত কথার মধ্যে ঘুরেফিরে আসে—এসব রুপভিলাষ’তাে কবিরই মানসক্ষেত্রে। হ্যাঁ, তা কেবল কবিই দেখেছেন, কিন্তু তার ভৈষজ্যগণের বিচার করেছেন বৈদ্যককুল। রূপের বন্দনা করার সময় কোথায় তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের বাধা দূর করতে একমাত্র বৈদ্যকেই অগ্রসর হতে হয় রােগ নিরাময়ের পথ বেছে নিতে।
পদ্ম ফুল এবং পাতার মধ্যে আছে ভেষজ গুণাগুণ। পদ্ম ফুল বাংলাদেশ ও ভারতের একটি পরিচিত জলজ সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই পদ্ম ফুলের ফুল এবং পাতা ঐতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে আসছে। পদ্ম বা পদ্মফুলের বোটানিক্যাল নাম Nelumbo nucifera Gaertn এবং এর পরিবারের নাম Nymphaeaceae. এই জলজ উদ্ভিদটির মূল থেকে ফল পর্যন্ত প্রতিটি অংশই ঐতিহাসিক কাল থেকেই রোগ প্রতিকারের বহুবিধ কাজে লাগানো হয়েছে।
পদ্ম ফুল এবং পাতার ব্যবহারিক গুণ:
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
১. পক্ষের পাতা (সহজ প্রাপ্য হলে) গরীবের ভোজনপাত্র বা তীর্থস্থানের প্রসাদ বিতরণের পাত্র হিসাবেও এর ব্যবহার আজও চলে আসছে, কিন্তু রোগপ্রতিকারে তার বিশেষ উপযোগিতাও আছে; এ তথ্য ঋষিকল্প কবিরাজ গঙ্গাধরের শিষ্যধারার জানা। তাঁরা শ্বেতী রোগীকে (শ্বিত্র রোগে) কচি পদ্মপাতায় গরম ভাত ঢেলে খেতে বলেন। এ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহকালে এইটুকু জানতে পারা যায় যে, রাঢ় অঞ্চলে লৌকিক টোটকা ঔষধ হিসাবে এর ব্যবহার এখনও প্রচলিত। রোগের প্রারম্ভে একনাগাড়ে এই পাতায় গরম ভাত ঢেলে খেতে হয়; কিন্তু বর্তমানকালে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এ ব্যবস্থা হয়তো সকলের পক্ষে সম্ভব হবে না সত্যি, কিন্তু গবেষকদের গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।
২. জ্বরের দাহে: পদ্মপাতার উপর শুয়ে থাকলে গায়ের জ্বালা কমে যায়। এটা চরকের ব্যবস্থা।
৩. হারিশে (এও এক ধরণের অর্শরোগ) (Rectal prolapse): যেসব শিশুর পায়খানার সময় মলদ্বারের উপর অংশ খানিকটা বেরিয়ে আসে (যাকে গ্রামাঞ্চলে হারিশ বা হালিশ বলে); সে ক্ষেত্রে কচি পদ্মের পাতা (যেগুলি তখনও প্রসারিত হয়নি) ৩ থেকে ৮ গ্রাম মাত্রায় (বয়সানুপাতে) অল্প চিনির সঙ্গে খেতে দিলে ওটি আর বাইরে আসে না। এ ব্যবস্থা কিন্তু আজকালের নয়, একাদশ খ্রষ্টাব্দ থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। এভিন্ন অনেক বৃদ্ধ বৈদ্য এই রোগে পদ্মের কচিপাতা বেটে কিছু মাখন মিশিয়ে মলদ্বারে কয়েক ঘণ্টা করে কয়েকদিন বেধে রাখতে ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন। (কৌপিন এটে)
৪. মায়েদের রোগ: প্রসবের পর বা যে কোনো কারণে নাড়ী সরে এলে (prolapse of uterus) পদ্মের কচিপাতা চিনি দিয়ে খেতে দেওয়াটা প্রাচীন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
৫. হৃৎ-শূল রোগে (Angina pectoris): আয়ুর্বেদের চিন্তাধারায় বিকৃত কফ ও পিত্ত ওই ধাতু দুটি রক্তাশয় বা হৃদগত হলে বায়ুর সাবলীল সঞ্চরণশীলতা স্বাভাবিক কারণেই বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং শূলবৎ বেদনা সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন বৈদ্যগণ পদ্মফুলের পাপড়ির রস খেতে দিতেন, এর দ্বারা হৃদগত সেই বিকৃত কফ ও পিত্ত সংশোধিত হয়। যার ফলে এই ব্যথা থেকে রোগী নিষ্কৃতি পায়।
৬. রক্তপিত্ত: যাঁদের মাঝে মাঝে গলা সুড়সুড় করে, হঠাৎ মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে বা দাস্তের সময় রক্ত পড়ে অথচ পেটে বা মলদ্বারে কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা থাকে না, সেক্ষেত্রে পদ্ম-কেশর চূর্ণ ৩ থেকে ৬ গ্রেণ মাত্রায় চিনি বা মধুর সঙ্গে খেলে রক্ত নির্গমন বধ হয়। অনেকে এর সঙ্গে একই বাসক পাতার (Adhatoda vasica) রস মিশিয়ে খেতে দিয়ে থাকেন।
৭. রক্তার্শ: এই পদ্মকেশরই উপরিউক্ত মাত্রায় উপশমদায়ক।
৮. অকালে গর্ভপাত বন্ধ: যাঁদের অকালে গর্ভপাত হয়ে যায় সেক্ষেত্রে ৩ থেকে ৪টি পদ্ম ফলের বীজের শাঁস বেটে সরবত করে ২ থেকে ১ দিন অন্তর খেলে এ দোষটি সেরে যায়।
৯. পিক্তাতিসারে: যাঁদের পাতলা ও সবুজাভ দান্ত হতে থাকে সেক্ষেত্রে পদ্মের ফেকড়ি বা নতির (যাকে মৃণাল বলা হয়) ২ থেকে ৩ চা চামচ রস চাল ধোয়া জলের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ ফোঁটা মধু মিশিয়ে খেতে দিলে ওটার নিবৃত্তি হয়।
১০. অনিয়মিত ঋতুস্রাব: মেয়েদের প্রতিমাসে ঋতুস্রাবে যদি অনিয়ম ঘটে পরে তা ক্ষতের আকার ধারণ করে, এক্ষেত্রে লাল পদ্ম বা লাল শাপলা (যার প্রচলিত নাম রক্তকম্বল, বোটানিক্যাল নাম: Nymphaea rubra) মূলের ক্বাথ চিনি মিশিয়ে স্রাব চলাকালীন কয়েকদিন খেলে এ রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়, তবে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে মাত্র ঐ কটাদিনই খেতে হয়। এ সম্পর্কে অন্যান্য উপসর্গগুলির দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
(সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ
ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন)।
তথ্যসূত্রঃ আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য রচিত চিরঞ্জীব বনৌষধি।
#