গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।। আজ ১০ মহররম, শনিবার পবিত্র আশুরা ও শহীদে কারবালা দিবস।মুসলিম উম্মাহর কাছে আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। কারবালা প্রান্তরে (৬১ হিজরির ১০ মুহাররম) মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাত বরণ ‘আশুরা’কে আরো গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। ফলে কারবালা ও কারবালা সংক্রান্ত সঠিক ইতিহাস জানা অতিব জরুরী নবীপ্রেম, প্রভুপ্রেমের মূল উপকরণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলো—তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)।
নবীজি সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভালোবাসার পূর্ণতা হলো আহলে বাইতের ভালোবাসা, যা আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘বলো—আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, চাই শুধু আমার স্বজনদের প্রতি ভালোবাসা।’ (সুরা-৪২ শুরা, আয়াত: ২৩)।
নবী পরিবার বা আহলে বাইত, যাঁদের ভালোবাসা ঈমানের সঙ্গে যুক্ত; তাঁরাই ফোরাতের তীরে কারবালার প্রান্তরে মহাপ্রভুর মহান প্রেমের নজরানা দিলেন। সফল ও সার্থক হলো চিরন্তন স্বার্থহীন অনন্ত প্রেম।
কারবালা পরাজয় নয়; বরং ঈমানের পরীক্ষার চরম সাফল্য। আহলে বাইত তথা নবী পরিবার—হযরত ফাতিমা (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হুসাইন (রা.) এই পরিবারের সদস্য। তাঁদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে নবী বংশ। নবী বংশেরই ৭০ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শাহাদাত বরণ করেছেন আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরীর কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে।
‘কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর, যেখানে ৬২ হিজরির মহররম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবারে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদত বরণ করেছিলেন। মানবতার ইতিহাসে এটি মহা বিয়োগান্ত ঘটনা। কারবালা যেন আরবি ‘কারব ও বালা’ এর সরল রূপে পরিণত। ‘কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মসিবত। তাই ‘কারবালা’ সংকট ও মসিবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহররম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় তাতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। এতে এই শাহাদাতের মাহাত্ম্য যেমন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আশুরা পেয়েছে ইতিহাসে নতুন পরিচিতি। আজ আশুরা ও কারবালা বা কারবালা ও আশুরা সমার্থক ও একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমগ্র পৃথিবীতে যেদিন পরিপূর্ণ রূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, কোনো নিষ্পাপ শিশু ও অবলা নারীর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না, সত্য ও সুন্দরের জয় হবে, অবনমিত হবে জালিমের খড়্গ, মানুষ পাবে তার বাক্স্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকার, প্রতিষ্ঠিত হবে সুষম সমাজব্যবস্থা, সে দিনই সার্থক হবে নবীর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মদান।
মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক শোক দিবস শোহাদায়ে কারবালা দিবস। ‘কারবালা’ আজও ঘটে চলেছে দেশে দেশে, দুনিয়ার সব নদী ‘ফোরাত’-এর কান্না হয়ে বয়ে চলেছে। ‘কুফা’ যেন কুফা হয়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছে মানবসভ্যতার ঘাড়ে, মানবাধিকারবঞ্চিত প্রতিটি জনপদে। কারবালার শিক্ষা হলো সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন নবীপ্রেম, আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মনিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখের সন্ধান করা। জুলুম ও অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা, সব সময় আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখা। প্রতিটি মহররম, প্রতিটি আশুরা ও শোহাদায়ে কারবালা দিবস আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে। ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তির পথ তৈরি করাই কারবালার মূল শিক্ষা।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘উত্তম জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।’ (তিরমিজি, আবুদাউদ ও ইবনে মাজাহ)।
(লেখক-গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্মীয় লেখক,চেয়ারম্যান-গাউছিয়া ইসলামিক মিশন।)
#