গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।।মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই দিনটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রিয় পাঠক আমি অধম চেষ্টা করব ঈদুল ফিতরের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার এবং একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা, ইবাদত – বন্দেগি সমূহ পরিশুদ্ধ ভাবে আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হওয়ার সঠিক ভাবে তুলে ধরতে – ইনশাআল্লাহ।
ঈদুল ফিতর: ঈদুল ফিতর শব্দটি ‘আওদ’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা। আর ফিতর শব্দের অর্থ হলো, ফাটল, ভেঙ্গে ফেলা, বিদীর্ণ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা ভেঙ্গে ফেলা হয় বলে এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর বলা হয়।
ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য ও করনীয়: মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: “আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞ হও।” (বাকারা-১৮৫)।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. ইরশাদ করেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন যখন আসে তখন আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের পক্ষে গর্ব করে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ তোমরাই বলো রোজাদারদের রোজার বিনিময়ে আজকের এই দিন কি প্রতিদান দেয়া যেতে পারে? সেই সমস্ত রোজাদার যারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরী আদায় করেছে, তখন ফেরেশতারা আল্লাহকে বলেন, হে দয়াময় আল্লাহ উপযুক্ত উত্তম প্রতিদান তাদের দান করুন । কারণ তারা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, প্রাপ্য পারিশ্রমিক তাদেরকে দান করুন।
তখন আল্লাহ তায়ালা রোজাদারদের কে বলতে থাকেন, ‘হে আমার বান্দা তোমরা যারা যথাযথভাবে রোজা পালন করেছ, তারাবীহর নামাজ পড়েছ, তোমরা তাড়াতাড়ি ঈদগাহে মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাও এবং তোমরা তোমাদের প্রতিদান গ্রহণ করো । ঈদের নামাজের শেষে আল্লাহ তা’য়ালা তার বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, হে আমার প্রিয় বান্দারা আমি আজকের এ দিনে তোমাদের সকল পাপগুলোকে পূর্ণের দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম । অতএব তোমরা নিস্পাপ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাও’। (বায়হাকী ও মিশকাত)
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেন: “আল্লাহ এ দু’টি দিনের পরিবর্তে অন্য দু’টি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হল ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি ‘ঈদুল আযহা’। তোমরা পবিত্রতার সাথে এ দু’টি উৎসব পালন করবে।’’ (আবু দাউদ ও নাসায়ী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: এদিনটিতে তোমরা রোজা রেখো না। এদিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনদের সাথে আনন্দ-উৎসব করার দিন। আল্লাহকে স্মরণ করার দিন।(মুসনাদ আহমাদ, ইবনু হিববান)
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, “ঈদের আনন্দ শুধু তাদের জন্য যারা রমজানের রোজা তারাবিহর নামাজসহ আল্লাহ তা’য়ালার যাবতীয় বিধি-বিধান গুরুত্ব সহকারে আদায় করেছে । আর যারা রমজানের রোজা ও তারাবীহ আদায় করেনি তাদের জন্য ঈদের আনন্দ নেই, বরং তাদের জন্য ঈদ তথা আনন্দ অগ্নিশিখা সমতুল্য।” (বুখারী)।
ঈদের রাতের ফজিলত: হযরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে আল্লাহর নিকট সাওয়াব প্রাপ্তির নিয়তে ইবাদত করবে তার হৃদয় সেদিনও জীবিত থাকবে যেদিন সকল হৃদয়ের মৃত্যু ঘটবে। (ইবন মাজাহ, হাদীস নম্বর ১৭৮২, আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নম্বর-১৫৯)।
মহানবী সা. আরো ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি দু’ঈদের রাতে পুণ্যের প্রত্যাশায় ইবাদত-বন্দেগী করে কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য রয়েছে মহা পুরুস্কার, অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোকদের অন্তর মরে যাবে, কিন্তু কেবল সেই ব্যক্তির অন্তর জীবিত থাকবে, সেদিনও মরবে না’। (আততারগীব)।
রাসূল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পুণ্যময় ৫টি রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে সেই ব্যক্তির জন্য সু-সংবাদ রয়েছে, আর সেই সুসংবাদটি হচ্ছে ‘জান্নাত’ এবং পুণ্যময় ৫টি রাত হলো ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, শবে বরাত, জ্বিলহজ্জের রাত, আরাফাতের রাত । (বায়হাকী) ।
ঈদের নামাজের সময়সীমা: সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোন নামায পড়া জায়েয নেই। ঈদুল ফিতরের নামায অপেক্ষাকৃত বিলম্বে এবং ঈদুল আযহার নামায আগে আদায় করা উত্তম।
বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামায পড়া জায়েয কি না। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদের দিনে বৃষ্টি হল, তখন রাসুল (স.) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে ঈদের নামায পড়লেন। (আবু দাউদ-১১৬২)। এতে বুঝা যায়, বৃষ্টি বা অন্য কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে ঈদের নামায মসজিদে পড়া জায়েয।
নামাজের জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে ৩টি, ৫টি এরকম বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া সুন্নত। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন সকালে বেজোড়সংখ্যক খেজুর খেতেন।(আদ-দুরূসুর রামাদানিয়াহ, পৃ. ১৮৫।)
আসুন এক নজরে জেনে নেই ঈদের সুন্নাতসমূহ:
১। অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া।
২। গোসল করা।
৩। শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা গ্রহণ করা।
৪।সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫। ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় আহার (যেমন খেজুর) গ্রহণ করা।
৬।সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া।
৭।ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সাদকাতুল ফিতরা আদায় করা।
৮।সম্ভব হলে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে ফিরে আসা।
৯।পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।
১০।ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিম্নোক্ত তাকবীর পাঠ করা:
(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।)
ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়: হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন, ‘যুবাইর ইবনে নফীর থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সময় সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, (তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম)। অর্থঃ আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী ৬/২৩৯, আসসুনানুল কুবরা লিলবাইহাকী, হাদীস-৬৫২১)।
সাদকায়ে ফিতর আদায়: রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটির দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী- ‘তুহরাতুল্লিস সায়িম’ অর্থাৎ একমাস সিয়াম সাধনায় মুমিনের অনাকাঙ্খিত ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হলো সাদকায়ে ফিতর।
ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ আদায় হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। সাদাকাতুল ফিতর বিষয়ক হাদীসগুলোতে পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ রয়েছে : গম, যব, খেজুর, কিশমিশ, পনির। সাদকায়ে ফিতরের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে পরিশুদ্ধ হয় ৷’ (সুরা আলা : আয়াত ১৪)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, গোলাম, স্বাধীন, পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সব মুসলিমের ওপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ‘সা’ খেজুর, অথবা অর্ধ ‘সা’ গম জাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং (ঈদের) নামাজের আগে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। এবার রাষ্ট্রের পক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মাথাপিছু ফিতরা ধার্য করেছে সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০টাকা।
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব , তাৎপর্য ও শিক্ষা অপরিসীম। প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে ধর্মীয় করণীয়গুলো পালনের মাধ্যমে নিজেকে একজন প্রকৃত মুমিন মুসলমান হিসেবে তৈরি করা জরুরি। পরিশেষে কামনা প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তির রোজা, সাহরি, ইফতার,তারাবি, ইবাদত – বন্দেগি,দান- সাদকা মহান আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন। আমিন।। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।
লেখক: গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান -গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।