প্রভাত সংবাদ ডেস্কঃ ওল বা ওলকচু কন্দোদ্ভব গুল্ম, বর্ষজীবী, কন্দ; এর সংস্কৃত নাম শূরণ, বন্য ওলের নামই শূরণ আর যেটা চাষে জন্মে তার নাম ভূকন্দ। অবশ্য হিন্দি নামের সঙ্গে এই নামের সাদৃশ্য আছে, ওসব অঞ্চলে বলে থাকেন ‘জমিন কন্দ’। এই কন্দ থেকে বহু সাদা শিকড় বেরোয়। এক একটা ওলের কন্দ এক/দেড় ফুট ব্যাস পর্যন্ত হতে দেখা যায়, গাছ ৩ ফুট পর্যন্ত উচু হ’তে দেখা যায়, ছত্রাকার পাতা। এর বৈজ্ঞানিক নাম Amorphophallus paeoniifolius বা Amorphophallus campanulatus (Roxb.); এটির বোটানিকাল নাম Amorphophallus sylvaticus (Dymock). এই বন্য ওলের কোষে SPTCS Calcium oxalate এক সূচগুচ্ছের সন্নিহিত থাকায় ওটা খেলেই গলায় তা বিধে যায়। তার জন্যই চুলকোতে থাকে ও ফুলে যায়, তেতুল বা লেবু, খেলে ঐ সূচগুলি গলে যায়। এই বন্য ওল বাংলাদেশে সাধারণের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয় না বটে, কিন্তু বোম্বাই অঞ্চলে একে চাকা চাকা করে কেটে শুকিয়ে “মদন-মস্ত’ নামে বিক্রি হয়। ওটি ওসব অঞ্চলে রসায়ন ঔষধ হিসেবে সাধারণ লোকে ব্যবহার করেন, তবে ব্যবহার করার পূর্বে তাকে শোধন করা হয় ।
ওল, কচু, মান তিনই সমান বলে দেশগাঁয়ে একটি কথা প্রচলিত, এটি তাদের স্বরূপগুণের কটুক্তি। আর একটি কথা আমরা প্রায়ই বলি ‘কচুপোড়া’, যদিও এটি অপদার্থের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু এরও যে প্রয়োজন আছে তা দেখতে পাচ্ছি এই ওলকে নাড়াচাড়া করতে বসে।
এখন কি করে পোড়াতে হবে তাই বলি-এখানে পোড়ানো অর্থ ঝলসানো। আন্দাজ ৭৫ বা ১০০ গ্রাম একটা ওলের টুকরো খোসা ফেলে মুখী বাদ দিয়ে মাটি লেপে, রোদে অল্প শুকিয়ে নিয়ে উনুনে ফেলে পোড়াতে হয়, যেমন করে কাঁচা বেল পোড়ানো হয়। তারপর উপরের মাটি অংশ ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ব্যবহার করাই সাধারণ বিধি।
রোগ প্রতিকার
°°°°°°°°°°°°°°°°
১. অর্শের জন্য কোষ্ঠবদ্ধতায়: এই ঝলসা পোড়া ওল, ঘি দিয়ে মেখে খেতে হয়, লবণ খুবই অল্প দিতে হয়, অবশ্য না দিলেই ভাল হয়। এটাতে ঐ কোষ্ঠবদ্ধতাটা চলে যাবে।
২. শোথে: এটা প্রায়ই আমের দোষ থাকার জন্য হয়, তবে পায়ের দিকে এই শোথটা দেখা দেয় কিন্তু কিডনির বা হৃদযন্ত্রের অর্থাৎ হার্টের দোষে পায়ে যে শোথ সেক্ষেত্রের জন্য এটা নয়, এক্ষেত্রে ঝলসানো ওল কাজ করে।
৩. অর্শের রক্তস্রাবে:স্রাব হয় বটে, তবে খুব কম, এক্ষেত্রে হয় টাটানি বেশী, আর তলপেটে যেন শূল ব্যথা, মনে হয় যেন আম হয়েছে; এক্ষেত্রেও ঐ ঝলসানো ওল ঘি দিয়ে মেখে খাওয়া।
৪. গাঁটে বাত: অনেক সময় এদের অর্শ থাকে, কারও রক্ত পড়ে কারও বা পড়ে না, এক্ষেত্রে ঐ গেঁটে বাত সেরে যাবে ঝলসানো ওল ঘি দিয়ে মেখে খেলে।
৫. গ্রহণী রোগে: এর প্রধান লক্ষণ দিনেই বার বার দাস্ত হয়, রাত্রে হয় না বললেই হয়। এরা ঝলসা পোড়া ওল খাবেন ভাতের আমানির সঙ্গে অর্থাৎ ভাতকে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন ঐ ভিজে ভাতের জলটাকেই আমানি বলা হয় তার সাথেই ওল খেতে হয়। এর দ্বারা ঐ দোষটা উপশম হবে। তবে পথ্যাশী না হলে গ্রহণী সারবে না।
৬. অর্শের জন্য অগ্মিমান্দ্যে: পেটে বায়ু, তার থাকবেই, তার উপর হজমও হয় না, আবার দাস্ত পরিষ্কারও হয় না, অথচ মলের কাঠিন্যও থাকে না, এক্ষেত্রে তক্র অর্থাৎ ঘোল দিয়ে ঐ ঝলসানো ওল খেতে হয়। আন্দাজ ৫o গ্রাম নিতে হবে। খেতে ভাল না লাগলে অল্প লবণ দিয়েও খাওয়া যায়; এর দ্বারা ঐ দোষটা চলে যাবে।
৭. মৃতবৎসার ক্ষেত্রে: একে গাঁয়ের ভাষায় বলে ‘মড়াঞ্চে দোষ’। অনেক মায়ের ৩/৪ মাসে অথবা ৭/৮ মাসেও নষ্ট হয়ে যায়, আবার কারও কারও জীবিত ভূমিষ্ঠ হয়েও কিছুদিনের মধ্যে মরে যায়, এক্ষেত্রে ঐ ওল পোড়া ৪০/৫০ গ্রামের সঙ্গে শ্বেত চন্দন ঘষা সিকি চা-চামচ মিশিয়ে খেতে হয়, এর সঙ্গে একটু ছাগলের দুধ মিশিয়ে দিলে আরও ভাল। তবে অনেক প্রাচীন বৈদ্য শালপানি (Desmodiumgangeticum) ১০/১২ গ্রাম ৩/৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে আধা কাপ থাকতে নামিয়ে সেটার সঙ্গেও এই ঝলসানো ওল খেতে দিয়ে থাকেন; অথবা যাকে আমরা চলতি কথায় বেড়েলা বলি, যার বোটানিকাল নাম Sidacordifolia, এর কথা দিয়েও খাওয়ার ব্যবস্থা দেওয়া হয়। পূর্বাক্তে ঐ শালপানির ক্বাথ তৈরীর নিয়মে এই বেড়েলার ক্বাথ তৈরী করতে হবে। তবে এটির প্রয়োগের ক্ষেত্র গর্ভসঞ্চার হলে তারপর।
৮. মদে অরুচি আনতে: সকালে ছাড়ে বিকেলে খায়, রোজই ছাড়ে রোজই খায়, সত্যিই যদি এ ঝোঁক কাটাবার ইচ্ছে থাকে, তা হলে ঝলসানো ওলের রস মদে মিশিয়ে ২ থেকে ৪ দিন খেলে আর দোকানের দিকে চাইতে ইচ্ছে করবে না। এটায় অসুবিধে হলে ঝলসানো ওলের চাট খেলেও ঐ কাজ হবে
৯. সস্তায় জমাট নেশা: যাঁরা অল্প পয়সায় নেশায় ভরপুর হতে চান — তাঁরা ঝলসা পোড়া ওলকে আগেরদিন মদে ভিজিয়ে রেখে, পরের দিন ছেকে নিয়ে ঐ মদটা খেয়ে দেখান, যাকে বলে তুরপের তাস।
১০. কফ প্রবণতায়: অনেক সময় দেখা যায় সাবধান থেকেও সার্দি কাশির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না, এর হেতুটা আরও পরিষ্কার হয়, যদি তাঁর নিজের অথবা তাঁর পিতা বা মাতার কারও অর্শের দোষ থেকে থাকে। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অর্শের সম্বন্ধ না থাকলেও, রক্তে দোষাংশ প্রবহমান, তাই এক্ষেত্রে একটু ওল পোড়া বা ঝলসা করে নারকেল কোরা ও ৫/৭ ফোঁটা ঘি মিশিয়ে খেলে ঐ সর্দির দোষটা নষ্ট হবে।
১১. বাতের ব্যথায়: ওলটা পুড়িয়ে থেতো করে অল্প ঘি মিশিয়ে অথবা এরণ্ডা তেল, যাকে আমরা চলতি কথায় রেড়ির তেল বলি, মিশিয়ে সহ্যমত গরম গরম পোটলা বেধে ব্যথার জায়গায় সেক দিলে যন্ত্রণাটা কমে যাবে।
১২. ছুলিতে: একে আয়ুর্বেদে সিধ্ম কুষ্ঠ বলে। ছুলির ওপর ঘি মাখিয়ে পোড়া ওল ঘষলে ২/৩ দিনের মধ্যেই উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাবে। (সিধমই যে ছুলি সেক্ষেত্রে মতভেদ আছে )
১৩. দদ্রুতে (দাদে): উপরিউক্ত নিয়মে ঘষলে ওটা তখনকার মত সেরে যাবে।
১৪. মুখের ক্ষতে: ওল বা ওলকচু কুচি কুচি করে কেটে শুকিয়ে নিয়ে মাটির কোনো পাত্রে মুখ বন্ধ করে লেপে, সেটা শুকিয়ে নিয়ে পোড়াতে হবে, তারপর সেই ওলপোড়ার ছাইকে একটু ঘি-এর সঙ্গে মিশিয়ে দাঁত মাজলে মুখের ও দাঁতের মাড়ির ক্ষত সেরে যাবে।
১৫. হাজা হলে: ওল বা ওলকচু-এর ডাঁটার রস ওখানে লাগালে ২ থেকে ৩ দিনেই আরাম হয়, তবে কারণটা যদি প্রতিনিয়ত চলতে থাকে তা হলে কোনোটাতেই একেবারে রুদ্ধ করা সম্ভব হয় না।
১৬. মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুল ও বিছার কামড়ে: সঙ্গে সঙ্গে ওলের ডাঁটা দংশিত স্থানে ঘষে দিলে ৫/৭ মিনিট পরেই যন্ত্রণার উপশম হবে।
একটা কথা এখানে বলে রাখি, মাটি না লেপে ওল পুড়িয়ে সেটা ব্যবহার করলে উল্টো ফল হবে; সুতরাং পূর্বোক্ত নিয়মেই ওলকে পোড়াতে হবে।
তথ্যসূত্রঃচিরঞ্জীব বনৌষধি‘