প্রভাত সংবাদ ডেস্ক: ‘হার্ট ককলস’ নামে ছোট্ট ঝিনুকটির চিনেবাদামের মাপের দু’টি ভাল্ভ থাকে। ওদের ওই পান পাতার মতো আকার দেখলেই চেনা যায়। তবে খুব ভাল করে দেখলে নজরে আসে একটি ছোট্ট ‘জানলা’।
শিনক্যানসেন— জাপানের বুলেট ট্রেন। মাছরাঙাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ট্রেনের সামনের অংশটি লম্বা ঠোঁটের মতো দেখতে বানিয়েছিলেন জাপানিরা। এতে ট্রেন চলাচলের সময়ে শব্দ কম হয়, কম বিদ্যুৎ খরচ হয়, গতি অনেক বেড়ে যায়। পানির নীচে যখন কোনও সমীক্ষা চালানো হয়, তখন ‘সোনার’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই প্রযুক্তিটি তৈরি করা হয়েছিল বাদুড় ও ডলফিনদের দেখে। ১৯০৩ সালে রাইট ভাইয়েরা প্রথম বিমান তৈরি করেছিলেন পাখিদের দেখে।
অতীতে জীবজগৎ ও প্রযুক্তির মধ্যে ব্যবধান ঘুচেছিল বারবার। তেমনই কিছু ঘটেছে ফের। তবে এ বারে কাহিনি কিছুটা ভিন্ন।
দেখে মনে হতে পারে ফুলের পাপড়ি। পানপাতা বা হৃদয়ের আকারের এক ধরনের ঝিনুকের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এটি ফাইবার অপটিকসের মতো একটি জিনিস ব্যবহার করে সূর্যালোককে তার খোলসের মধ্যে ঢোকার পথ করে দেয়। ঠিক যে ভাবে টেলিকমিউনিকেশন সংস্থাগুলি ফাইবার অপটিকসের সাহায্যে ঘরে ঘরে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেয়। বিষয়টি দেখে বিজ্ঞানীরা বেশ চমৎকৃত। কারণ এই প্রথম কোনও প্রাণীর দেহে ‘ফাইবার অপটিকস’ প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে পাওয়া গেল। (অপটিকাল ফাইবার হল একটি নমনীয়, স্বচ্ছ প্লাস্টিক বা কাচের সুতোর মতো সরু অংশবিশেষ, যা আলোকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে সাহায্য করে। এটি যোগাযোগ ব্যবস্থা, ছবি তোলা, বায়োমেডিক্যাল প্রযুক্তিতে ব্যবহার হয়।) পরীক্ষানিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, কী ভাবে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের অগভীর জলের বাসিন্দা ‘হার্ট ককলস’ নামে ঝিনুকটি তার ঘরের ‘ভাড়াটে’ শৈবালটির জন্য সূর্যালোক সংগ্রহ করে, আবার একই সঙ্গে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ওই শৈবালকে বাঁচায়। এই সাহায্যের বিনিময়ে শৈবালটি ঝিনুকটিকে শর্করা ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ সরবরাহ করে।
মানব সমাজে প্রযুক্তির আকাশছোঁয়া উন্নতির পাশাপাশি প্রায় সমান্তরাল ভাবে জীবজগতেও যে বিবর্তন ও অভিযোজন ঘটে চলেছে, তা মনে করিয়ে দিয়েছে এই গবেষণা। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, প্রকৃতির এই সৃষ্টি ভবিষ্যতে ‘বায়ো-ইনস্পায়ারড অপটিকাল সিস্টেম’ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। সম্প্রতি ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্রটি।
‘হার্ট ককলস’ নামে ছোট্ট ঝিনুকটির চিনেবাদামের মাপের দু’টি ভাল্ভ থাকে। ওদের ওই পান পাতার মতো আকার দেখলেই চেনা যায়। তবে খুব ভাল করে দেখলে নজরে আসে একটি ছোট্ট ‘জানলা’। এই স্বচ্ছ অংশটি ঝিনুকের খোলসের ভিতরে আলোর প্রবেশের পথ করে দেয়। অংশটি ক্যালসিয়াম কার্বনেটের ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি। এই ক্রিস্টালগুলি একটি খুদে টিউবে মতো করে সাজানো থাকে। এই টিউবটি ফাইবার-অপটিকস কেবলের মতো কাজ করে। নিখুঁত পারদর্শিতার সঙ্গে আলোকে পথ দেখায়। কিন্তু আলোয় ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থাকতে পারে। ওই রশ্মি ঝিনুকটির ঘরের বাসিন্দা শৈবালের ক্ষতি করতে পারে, এমনকি ঝিনুকের কলাকোষেরও বিপদ ডাকতে পারে। এর প্রতিরোধ ব্যবস্থাও রয়েছে। আলো থেকে ছেঁকে অতিবেগুনি রশ্মির অনেকটাই বাদ দিতে পারে
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভোলিউশনারি বায়োলজিস্ট ডাকোটা ম্যাকয় ও তাঁর সহকর্মীরা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখেছেন, ঝিনুকের খোলসের যে দিকটা সূর্যের দিকে থাকে, সেখান দিয়ে যে পরিমাণ সালোকসংশ্লেষে সক্ষম আলো প্রবেশ করে, তার অর্ধেক পরিমাণ ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ করে। সমুদ্রের বাসিন্দা এই খুদে প্রাণীটির কর্মকাণ্ড দেখে অনুপ্রাণিত ডাকোটা জানিয়েছেন, তাঁরা এই ঝিনুকের চরিত্র, তার ক্যালসিয়াম কার্বনেটের গঠন, সূক্ষ্ম টিউব— এ সব দেখে একটি সমচরিত্রের পদার্থ তৈরির কথা ভাবছেন, যাতে এর থেকেও ভাল অপটিকাল গুণাগুণ থাকবে, যা ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিতে ভবিষ্যতে বিপ্লব আনবে।
সূত্র : আ/বা