প্রভাত সংবাদ ডেস্ক : রসুন লিলিয়াসি পরিবারের এলিয়াম গণের বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর বোটানিক্যাল নাম Allium sativum Linn. নিম্নে রসুনের ভেষজ গুণ ও লোকায়তিক ব্যবহার সম্পর্কে উল্লেখ করা হলোঃ-
১. ঢলা যৌবন: কোনো দিকেই একে ধরে রাখা যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে (ক) দু’ কোয়া রসুন গাওয়া ঘিয়ে ভেজে মাখন মাখিয়ে খেতে হয়, খাওয়ার শেষে একটু গরমজল পান করা উচিত। (খ) আটার সঙ্গে রসুন বাটা মিশিয়ে রুটি বা লুচি করে খাওয়া। (গ) ছাতুর সঙ্গে একটু, ঘি, চিনি ও একটু রসুন বাটা মিশিয়ে খেলেও হয়।
২. যৌবন রক্ষায়: কাঁচা আমলকীর রস দুই বা এক চামচ নিয়ে তার সঙ্গে এক বা দুই কোয়া (নিজের শরীরের সহ্যাসহ বুঝে) রসুন বাটা খেতে হয়, এটাতে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েরই যৌবন ধরে রাখে। যৌবনের প্রারম্ভ থেকে ব্যবহার করলে নারী থাকে তন্বী।
৩. দুই বা এক কোয়া রসুন চিবিয়ে খেয়ে ও একটু গরম দুধ খেলে যেসব ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায় (ক) স্বল্প মেধায় (খ) বিস্মরণে (গ) কৃমিতে (ঘ) রাতকানায় (ঙ) শুক্রতারল্য (চ) চুলকণায় (ছ) পাথুরীরোগে (জ) জীর্ণ জ্বরে (ঝ) শরীরের জড়তায়।
৪. শিশুর স্বাস্থ্যহানি রোধে: হাড়সার শিশুর গায়ে মাংস লাগাতে চাইলে, ভাতের সঙ্গে টাটকা ঘোল ও সিকি (১/৪) বা আধ (১/২) কোয়া রসুন কিছুদিন খাইয়ে দেখুন।
৫. পেটের অসুখে: এর সঙ্গে অনেক সময় শ্লেমাও যোগ থাকে, এ ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা জলে ২৫ ফোঁটা রসুনের রস মিশিয়ে খেলে অনেকক্ষেত্রে এটার উদ্বেগ চলে যায়। এক ভাগ রসুন, সৈন্ধব নুন ও ঘিয়ে সেঁকা হিং একের চারভাগ এবং আদার রস রসুনের দেড় গুণ পরিমাণ একসঙ্গে মিশিয়ে পান করলে পেটের রোগ বা উদররোগ সারে, পেটের জমা হওয়া চর্বি কমে যায় আর কোষ্ঠ সাফও ভাল ভাবে হয়ে যায়।
৬. বাতজনিত ব্যথায়: গাওয়া ঘিয়ের সঙ্গে দুই থেকে তিন কোয় রসুন বাটা খেতে হয়; অথবা ৫ থেকে ৭ ফোটা রসুনের রস ঘিয়ে মিশিয়ে খেলেও হয়। সরষের তেলে রসুন ভেজে সেই তেল মালিশ করলে বাতের যন্ত্রণা কমে যায়।
৭. শরীর ক্ষয়ে: খায় দায়, শুকিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে এক বা দুই কোয়া রসুন বেটে এক বা আধ পোয়া দুধে পাক করে সেটা খেতে হয়। এটাতে ক্ষয় বন্ধ হবে; অধিকন্তু আস্তে আস্তে ওজন বেড়ে যাবে।
৮. মদ্যপায়ীর পেটে: অনেক সময় শূল ব্যথা ধরে, অথচ তাকে পরিত্যাগ করার থেকে তার মরাটা সহজ এই মনোভাব, এ ক্ষেত্রে তাঁরা একটা কাজ করে দেখতে পারেন, দুই এক কোয়া রসুন খাবেন, এ অসুবিধেটা আর থাকবে না।
৯. শুক্রতারল্যে: অল্প গরম দুধের সঙ্গে ২ থেকে ১ কোয়া রসুন বাটা খেলে শক্রতারল্য হয় না; অস্থির বল বাড়ে; অস্থির ক্ষয় হ্রাস পায়; শরীরের নিত্য ক্ষয় দূর হয়।
১০. রোগে প্রতিরোধক: নিত্য এক কোয়া রসুন অল্প গরম দুধে মিশিয়ে খেলে উপকার হবে]
১১. নরম মাছে: সংসারে অনেক সময় ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় অনেক কিছুই এসে যায়; সে ক্ষেত্রে একটু, রসুন বাটা দিয়ে রান্না করলে শরীরের ক্ষতিকারক দোষ অংশটা অনেক কেটে যায়, এটা কিন্তু আয়ুর্বেদ সম্মত বিধি নয়, এভাবে খেলে রক্ত দুষিত হতে পারে।
১২. কুকুরে কামড়ালে: বর্তমান পাশ্চাত্য চিকিৎসার ক্রমকে মানতে হবে, তবে যদি তার আদৌ প্রয়োজন না থাকে, তা হ’লেও কিছুদিন রসুনের রস ২ থেকে ৫ ফোঁটা অল্প গরম জলে বা দুধে মিশিয়ে খাওয়া ভালো। গ্রীক দেশের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে এটা লিপিবদ্ধ আছে।
১৩. পুরাতন জ্বর: জ্বর ছাড়ে না; বাড়ে কমে কিন্তু একটু থেকে যায়, যাকে বলা হয় ঘুসঘুসে জ্বর। এক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ ফোঁটা রসুনের রসের সঙ্গে আধ বা এক চামচ গাওয়া ঘি মিশিয়ে খেলে দুই চার দিনের মধ্যে জ্বর ছেড়ে যাবে।
১৪. অটারিওস্কেলেরোসিস: (Arteriosclerosis) একটু, বয়স হলে শুদ্ধ রক্তবাহী শিরাগুলির স্থিতিস্থাপকতা অর্থাৎ ইলাসটিসিটি (elasticity) কমে যেতে থাকে, সে ক্ষেত্রে এটি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে ঐ অসুবিধেটা সৃষ্টি হয় না।
১৫. এমফাইসিমা (Emphisema) রোগ: এই রোগটি হাঁপানি, তবে অসুবিধে এটাতে নিঃশ্বাস ছাড়তে কষ্ট হয়। ৫ থেকে ৭ ফোঁটা রসুনের রস ঠাণ্ডা দুধে মিশিয়ে রোজ একবার করে খেলে অনেকক্ষেত্রে ঐ রোগের উপশম হয়।
১৬. মাথা ধরা বা ব্যাথায়: সর্দি হয় না অথচ মাথা ধরে (বায়ুর জন্য)। এই সমস্যা সমাধানের উপায় দুই-এক ফোঁটা রসুনের রসের নস্যি নেওয়া। আর একটা কথা-এর রস গায়ে লাগলে চামড়ার কোনো অনিষ্ট করে না।
১৭. ক্ষতে: ক্ষত কিছুতেই যেতে চায় না; একটু ঘিয়ের সঙ্গে রসুন বাটা ক্ষতে লাগালে ওটা কেটে যাবে।
১৮. অরুচি দূর করতে: রসুন, ধনেপাতা, আদা, সাদা আঙুর, চিনি ও সৈন্ধব লবণ একসঙ্গে পিষে নিয়ে চাটনি তৈরি করে খেলে অরুচি দূর হয় ও খাবার সহজে হজম হয়।
১৯. ক্ষতের ক্রিমিতে: ক্রিমিতে অনেক সময় পচা ঘায়ে পোকা জন্মে। বিশেষত গরু, মহিষের প্রায়ই এটা হতে দেখা যায়। এ সব ক্ষেত্রে রসুন বটে গায়ে লাগালে পোকা হয় না, আরো হ’লেও মরে যায়।
২০. ব্রণ রোগে: ব্রণ রোগর সঙ্গে সঙ্গেই যদি রসুনের প্রলেপ লাগানো হয় তাহলে ব্রণ আর বাড়বে না।
২১. কানের ব্যথা সারাতে: রসুনের কোয়া সর্ষের তেলে ভেজে নিয়ে এই তেলের ফোঁটা কানে দিলে কানের ব্যথা সেরে যায়। কান পেকে গেলেও এতে লাভ হয়।
২২. বিছের কামড়ে: রসুন পিষে লাগালে জ্বালা কমে যায়। রসুনের রসে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে চেটে খেলেও তৎক্ষণাৎ উপকার পাওয়া যায়।
২৩. চুলকুনি: রসুনের প্রলেপ চুলকুনিতে লাগালে চুলকুনির ওপরের পাপড়ি নরম হয়ে গিয়ে ঝরে যায় ও ত্বকের লাল অংশ বেরিয়ে আসে। এর ওপরে ভাল মলম লাগালে আরাম পাওয়া যায়।
গন্ধ দূর করতে:
খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় রসুনের গন্ধটাই সমস্যা সৃষ্টি করে, এ উপলব্ধি সকলেরই হয়। তাই রসুনের কোয়ার উপরের খোসা ছাড়িয়ে, আধখানা করে কেটে টক দই পুর্বের দিন রাত্রে ভিজিয়ে রেখে তার পরের দিন খাওয়ার পুর্বে ওটা ধুয়ে নিলে ঐ অভা গন্ধটা আর থাকে না। এটাও না খেতে পারলে ঘিয়ে ভেজে শাক কিবা তরকারির সঙ্গে মিশিয়ে খাবেন। অথবা মাংস বা দইএর সঙ্গে সিদ্ধ করে খাবেন।
হাকিমি বা ইউনানি মতে:
রসুন দাহক, তীক্ষ্ণ, মূত্রল অর্থাৎ প্রস্রাব বেশি করায়, পেটের বাত দূর করে, বিষহরণ করে ও কামোদ্দীপক। শরীর ফোলা, পক্ষাঘাত, গেঁটে বাত, যকৃৎ ও প্লীহাবৃদ্ধি, লিভার বেড়ে যাওয়া, খিদে বেড়ে যাওয়া, হার্ট ও ফুসফুসের রোগের অব্যর্থ ওষুধ বা মহৌষধ। একটানা জ্বর, শ্বেতী এবং রক্ত ঘন হওয়া দূর করে। গলার স্বর ভাল করে, দাঁতের রোগ সারায়।
বৈজ্ঞানিকদের মতে:
১. রসুন উষ্ণ, লঘু, মনের উৎসাহ বৃদ্ধি করে উদ্দীপিত করে, উদরবাত সারায়, কৃমি সারায়।
২. এছাড়াও শরীর সবল করে, উত্তেজনা সৃষ্টি করে, কফ সারায়, পচে যাওয়া প্রতিরোধ করে, মূত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, বাত সারায় এবং বলকারক।
৩. রসুনে ক্যালসিয়াম, পাটাসিয়াম, ফসফরাস, প্রভৃতি খনিজ আছে। এছাড়াও আছে একালি ও আয়োডিন। রসুনে ভিটামিন ‘বি’, ‘সি’ এবং অল্প পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ আছে।
৪. রসুনের এলায়ল সালফাইড ফুসফুসের ক্ষয়, গ্রস্থিক্ষয়, গলগণ্ড, পেটের ক্ষয়, ত্বকের ক্ষয় প্রতিরোধ করে।
৫. পচন নিবারণের পক্ষে রসুনের গুণ অমৃতের মতো।
৬. রসুনে জীবাণুনাশক অ্যান্টিসেপ্টিক গুণ প্রচুর পরিমাণে আছে।
৭. রসুন ক্ষয় রোগ নিবারণ করে। নিয়মিত রসুন খেলে ক্ষয়রোগ হয় না।
৮. শোথ ও জলোদর (ড্রপসি) রোগের পক্ষেও রসুন উপকারী।
৯. প্রসূতির পক্ষে রসুন খাওয়া তো খুবই ভাল।
১০. বৃদ্ধাবস্থায় যদি বহুদিন ধরে অসুস্থ থাকবার পর শারীরিক শক্তি কমে যায় তাহলে শীতকালে নিয়ম করে রসুন খাওয়া উচিত। রসুন ব্যাকটেরিয়া রোধ করে কাজেই শাসনালী ও ফুসফুসের অসুখে রসুন খেলে উপকার পাওয়া যায়।
১২. শ্বাসনালীর জমা হয়ে থাকা কফ সরল করে, কিডনির পাথর মূত্রের সাহায্যে বাইরে বের করে দেয়।
১৩. পচা গলা ঘায়ে রসুনের প্রলেপ খুবই উপকারী-রসুন ঘামের সমস্ত জীবাণু বিনষ্ট করে।
১৫. নিয়মিত রসুন খেলে শরীর বলবান, নিরোগ ও তেজোপূর্ণ হয় ।
বৈদ্য শাস্ত্রমতে রসুন ও রসুনের নানা নাম:
***************************************
বৈদ্য শাস্ত্র মতে রসুনের অনেক গুণ আছে। অন্যান্য নানান ব্যাধি সারানোর সঙ্গে সঙ্গে রসুনের আরও কয়েকটি বিশিষ্ট গুণ হল রসুন খাদ্যরুচি বৃদ্ধি করে। বলকারক, পুষ্টি বৃদ্ধি করে, মেধা বাড়ায় এবং চোখের পক্ষে নানা গুণের সমাবেশের জন্যে রসুনের আরও কয়েকটি নাম আছে যেমন উগ্রগন্ধ (গন্ধ বেশি উগ্র বলে এই নাম), শীতবর্ধক, বাতারি (বাত সারিয়ে তোলে অথাৎ বাতের অরি বা শত্রু), অরিষ্ঠ, ভূত ও মহৌষধ।
(নিষেধ: মাছের সঙ্গে, কাঁচা দুধের সঙ্গে রসুন খেতে নেই, এর দ্বারা রক্ত দূষিত হয়।)
তথ্যসূত্রঃ আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য রচিত,
চিরঞ্জীব বনৌষধি।