শিশির সমরাট ।। কুমিল্লায় বর্ষাকালে দেখা নেই বর্ষণের। প্রচন্ড তাপদাহে পুড়ছে নদীনালা খালবিল। বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ।
গ্রীষ্মের পরেই বর্ষার আগমন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপে যখন প্রকৃতি জ্বলেপুড়ে একাকার তখন শান্তির পরশ নিয়ে আগমন ঘটে বর্ষাকালের। দিনরাত অবিরাম বৃষ্টির ধারা প্রকৃতিকে করে তােলে শান্ত ও মনােরম। আকাশে মেঘের গর্জন ও বিদ্যুতের চমকে শিহরিত হয় শরীর ও মন। বৃষ্টির পানিতে নদী- নালা- খাল- বিল টইটম্বুর হয়ে যায়। নতুন পানি পেয়ে ব্যাঙ ডাকতে থাকে- ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। নতুন পানিতে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আনন্দে মেতে উঠে। সে পানিতে প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেয় বিভিন্ন প্রজাতির ছোট ছোট মাছ। গ্রাম বাংলায় সে মাছ ধরতে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ আনন্দের সাথে নানা প্রকার জাল নিয়ে পুকুর খালে নদীতে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায়না।
এখন বর্ষাকাল আষাঢ়ের শেষ, কিন্তু দেখা নেই বর্ষনের। প্রচন্ড তাপদাহে শুকিয়ে পানি শূন্য কুমিল্লার নদীনালা খালবিল। বর্ষার বর্ষণ না থাকায়
শস্য ও মৎস্য ভান্ডারখ্যাত কুমিল্লার খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়ে পানি জমা না হওয়ায় বিলুপ্ত প্রায় পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ।
জেলার মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই এখন অনেক প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে ।
প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জলাভূমির সঙ্গে বিশেষ করে প্লাবনভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। এছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্হল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার।
বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মধ্যে রয়েছে- চ্যাপিলা, বইচা, চাটুয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, কই, টাকি, তেলা টাকি, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনাসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ।
কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হুমায়ুন কবির জানান, একসময় বিলে ও সড়কের পাশের খাল গুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। সকাল বেলা শহর ও শহরতলীর প্রতিটি বাজার ভরে যেত দেশীয় মাছে। অথচ বিলের অধিকাংশ এলাকা এখন ফসল চাষের আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার ও পানি স্বল্পতার কারণে এখন আর মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এবছর বর্ষাকালের অর্ধেক সময় আষার মাস চলে গেছে কিন্তু পানির দেখা নেই। তাহলে প্রাকৃতিক ভাবে মাছের প্রজনন, বিস্তার কোথা থেকে হবে?
কুমিল্লা চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক মোঃ জালাল বলেন, ‘প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পুষ্টিগুণসম্পন্ন মাছ বহুলাংশে কমে গেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক। আকারে ছোট হলেও এসব দেশীয় মাছ পুষ্টিগুণে ভরা। এসব মাছ বিলুপ্তির ফলে পুষ্টির বড় উৎসও হারিয়ে যাবে। বড় মাছে অধিক পরিমাণে প্রোটিন থাকে, কিন্তু ছোট মাছে প্রোটিন ছাড়াও ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন ও ভিটামিন থাকে, যা চোখ ভালো রাখে এবং দেহগঠনে সহায়তা করে। এছাড়া কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে, ফুসফুসের প্রদাহ কমায় এবং দাঁত ও হাড়ের গঠন ভালো রাখে।’
কুমিল্লা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার মতে, জলাশয় গুলোতে ডিমওয়ালা মাছ অবমুক্তকরণ, ছোট মাছের উপকারিতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, জেলে পরিবারগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরার পরিবর্তে বিকল্প কর্মসংস্হানের ব্যবস্হা করলে পুনরায় মাছের সুদিন আসতে পারে।
পরিবেশ বাদীদের মতে, সমন্বিত বালাইনাশক প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন।
#প্রভাত সংবাদ /