গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।। রমজান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই মাসে তেল, চিনি ,ডাল,ছোলা, খেজুরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশে এসব পণ্যের কোনো প্রকৃত সংকট নেই। পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও দাম কেন বাড়ে? এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো বাজার সিন্ডিকেট- যেখানে কিছু ব্যবসায়ী এবং আমদানিকারক মিলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে, সাধারণ ভোক্তাদের অসহনীয় ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
বাজারে দাম বৃদ্ধির এই চক্র মূলত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে নিয়ন্ত্রিত। তারা একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট তৈরি করে এবং পরিকল্পিতভাবে বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরিয়ে রাখে। ফলে, পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার ভান করে তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয়। এই সিন্ডিকেট শুধু ব্যবসায়ী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তাও তাদের পক্ষে কাজ করেন। ফলে, সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতিগুলো কার্যকর হয় না
এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা আগে থেকেই জানেন যে, রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যাবে। তাই তারা মাস কয়েক আগে থেকেই পণ্য মজুত করতে শুরু করেন। তারপর বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ধাপে ধাপে দাম বাড়ান। অনেক সময় তারা গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে গুজব ছড়ায়- দেশে পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, কিংবা পরিবহণ খরচ বেড়ে গেছে। এসব অজুহাত দিয়ে তারা সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করেন- যাতে মানুষ বেশি পরিমাণে কিনতে শুরু করে। ফলে, সংকট আরও তীব্র হয় এবং দাম আরও বাড়তে থাকে।
বাজার সিন্ডিকেটের এই দৌরাত্ম্যের ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের মাসিক বাজেট এলোমেলো হয়ে যায়। অনেকেই রমজান মাসে একটু ভালো খাবারের পরিকল্পনা করেন, কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে তা সম্ভব হয় না।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রথমেই বাজার সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিয়মিত মনিটরিং বাড়াতে হবে এবং পণ্য মজুতদারদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের উচিত রমজানের আগেই পর্যাপ্ত পণ্য মজুত নিশ্চিত করা এবং স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা- যাতে কেনাকাটা করতে পারে। সাধারণ মানুষ ভোগান্তি ছাড়া খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেন- যা পুষ্টিহীনতার কারণ হতে পারে।
বাজারে ভোক্তাদের দুর্ভোগের আরেকটি বড় কারণ ,সাধারণ মানুষ তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করলেও মূল সমস্যা থাকে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে।
প্রশ্ন হলো, সরকার কি এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়? অবশ্যই জানে এবং মাঝে মাঝে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিযান চালায়। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে কিছু দোকানে জরিমানা করা হয়, কিন্তু এতে বড় কোনো পরিবর্তন আসে না। কারণ এসব জরিমানা সাময়িক প্রতিরোধ সৃষ্টি করলেও বাজার সিন্ডিকেটকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে কঠোর
নজরদারি ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, এবং যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা যেন কঠোর আইনি শাস্তির আওতায় আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সমন্বিত ভূমিকা জরুরি। শুধু অভিযান চালিয়ে নয়, বরং আমদানি, সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে হবে।
রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রথমেই বাজার সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিয়মিত মনিটরিং বাড়াতে হবে এবং পণ্য মজুতদারদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের উচিত রমজানের আগেই পর্যাপ্ত পণ্য মজুত নিশ্চিত করা এবং স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা- যাতে সাধারণ মানুষ ভোগান্তি ছাড়া কেনাকাটা করতে পারে।
এছাড়া, একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। সরকারি সংস্থাগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে পণ্যের সরবরাহ ও মজুতের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করলে সিন্ডিকেটের কারসাজি ধরা সহজ হবে। একই সঙ্গে ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি- যাতে তারা অযথা আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত কেনাকাটা না করেন- যা বাজারে কৃত্রিম সংকট বাড়িয়ে দেয়।
রমজান সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস, কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে এই পবিত্র মাস ভোগান্তির মাসে পরিণত হয়। নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের এই অশুভ দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে সাধারণ মানুষ প্রতি বছর একই সমস্যার মুখোমুখি হবে। বাজার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং জনসচেতনতা বাড়ানো। তাহলে হয়তো একদিন রমজানকে সত্যিকারের সংযম ও শান্তির মাস হিসেবে উপভোগ করা সম্ভব হবে।
লেখক: গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ বিশ্লেষক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান, গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।
#