গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।। মাহে রমজান ছিল মুমিন বান্দার জন্য মহাআনন্দের মাস। ইবাদতের মাধ্যমে জান্নাত লুফে নেওয়ার ও রবের সান্নিধ্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। এই মাসে আল্লাহ তার বান্দাকে ক্ষমার ঘোষণা দেন এবং বান্দার জন্য রাখেন বিশেষ প্রতিদান। সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো- রব রোজাদারকে নিজ হাতেই রমজানের প্রতিদান দিবেন। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে- হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি আমল তার জন্য। কেন না, রোজা হলো আমার জন্য। আর আমি নিজেই তার প্রতিদান দিব। রোজাদারের মুখের গন্ধ (ক্ষুধার কারণে যা সৃষ্টি হয়) আল্লাহর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়। (বোখারি-১৮৯৪)।
কোরআনে পাকের মধ্যেও এমন প্রতিদানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ ,তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেমন করা হয়েছে, তোমাদের পূর্বসূরিদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। (সূরা বাকারা-১৮৩)। আর তাকওয়া একমাত্র আল্লাহর জন্যই হয়। তার প্রতিদানও মহান রব নিজে দিবেন। দ্বিতীয়ত: দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর একদিকে রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের বিদায়ে রোজাদার মুমিন বান্দা ভারাক্রান্ত/ব্যথিত অপর দিকে রোজা শেষে ঈদের আনন্দ, খুশি প্রকাশে ঈদুল ফিতর উদযাপন নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা :
ঈদের পূর্বে করনীয়:
ঈদের সালাতের পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা অন্যতম সওয়াবের কাজ। হাদীস শরীফে এসেছে,“হযরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সা: সাদাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন,যেন সিয়াম পালন কারী বাজে কথা, অশ্লীল কথা ( ইত্যাদি ছোট খাট অপরাধ) থেকে পবিত্রতা লাভ করে এবং দরিদ্র মানুষ যাতে খাদ্য লাভ করে। যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের আগে আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গন্য হবে। আর যে ব্যক্তি তা ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তার জন্য তা একটি সাধারণ দান বলে গন্য হবে” । (সুনানে আবু দাউদ:২/১১১)
ঈদের দিনে করনীয়:
১. অন্য দিনের তুলায় সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। (বায়হাকী:৬১২৬)
২. মিসওয়াক করা। হাদিসে রাসুল সা: বলেন: “ যদি আমি আমার উম্মতের উপর কষ্টের আশঙ্কা না করতাম, তাহলে আমি তাদের প্রত্যেক সালাতের সময় মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম”।( বুখারী ও মুসলিম)
৩. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করা, ইবনে মাজাহ: ১ /৩১৫
৪. শরীত সম্মত সাজসজ্জা করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫. ঈদুল ফিতরের সালাতে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া। যেমন খেজুর খাওয়া। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাযের পর নিজের কুরবানীর গোশত আহার করা উত্তম। আনাস রা: থেকে বর্ণিত:”রাসূলুল্লাহ সা : ঈদুল ফিতর দিন খেজুর খাওয়া পর্যন্ত অন্য কোন খাবার খেতেন না”।( বুখারী:৯৫৩)
৬. সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। (আবু দাউদ: ১১৫৭)
৭. ঈদের সালাতের পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন-
“যে ব্যক্তি সাদাকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের আগে আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গন্য হবে। আর যে ব্যক্তি তা ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তার জন্য তা একটি সাধারণ দান বলে গন্য হবে” । (সুনানে আবু দাউদ:২/১১১)
৮. ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপরাগতায় মসজিদে আদায় না করা। (বুখারী:৯৫৬)
যদি একান্ত মসজিদে আদায় করতে হয় তবে অবশ্যই মসজিদের প্রবেশের পর দু’ রাকাত নামাজ আদায় করা।
রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, “যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন দু’রাকাত সালাত আদায় করা পর্যন্ত না বসে” (সহীহ বুখারী: ৭৬১১)
৯. ঈদের সালাতে এক রাস্তা দিয়ে সম্ভব হলে অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন:
“রাসূলুল্লাহ সা: ঈদের দিনে (ঈদগাহ থেকে ফিরার সময়) বিপরীত রাস্তা দিয়ে হাটতেন”। (বুখারী: ৯৮৬)
১০.. ঈদুল ফিতরের দিন আস্তে আস্তে
তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে। (মুসতাদরিক হাকেম:৫০১১)
আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর”। (সূরা বাকারা: ১৮৫)
তাকওয়ার অনুশীলন:
মাহে রমজান ছিল তাকওয়া অর্জনের মাস। আমরা রমজানে যেভাবে তাকওয়ার অনুশীলন করি, রমজান শেষ হলে আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অথচ কথা ছিল রমজানে তাকওয়ার যে প্রশিক্ষণ আমরা পেয়েছি তা সারা বছর কাজে লাগিয়ে জীবন পরিচালনা করব। এক জন রোজাদারের এই কথা মনে রাখা উচিত যে, যেই আল্লাহর সন্তষ্টি ও তাঁর ভয়ে সারাদিন ক্ষুধার যাতনা সহ্য করেছি সেই আল্লাহকে যদি রমজানের বাহিরে বাস্তব জীবনে ভয় করতে না পারি তাহলে তার রোজা শুধুমাত্র উপবাস ছাড়া আর কিছূই নয়। আমরা সামান্য বিপদে পড়লে বা কোন প্রকার হতাশ হলেই তাকওয়ার বিপরীত কাজ করে থাকি। অথচ তাকওয়া হলো সকল বিপদে আপদে আল্লাহর উপর ভরসা করে অন্যায় পথ থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:“ যে আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন এবং তিনি এমন উৎস থেকে রিযিক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনা”। (সূরা ত্বালাক:২-৩)। সুতরাং সর্বাবস্থায় তাকওয়ার পথ অনুসরণ করা একজন রোজাদারের বড় প্রশিক্ষণ।
কোরআনের পথে আসতে হবে:
রমজান হলো পবিত্র কোরআনের মাস। রমজানের এত কদর ও সম্মান মূলত কোরআনকে ঘিরেই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন:“রমজান মাস! যাতে সমগ্র মানব জাতীর হেদায়েতের জন্য কোরআন নাযিল করা হয়েছে। যা স্পষ্ট হেদায়েতের বাণী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী”। (সূরা বাকারা: ১৮৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:“আমি যদি এই কোরআনকে কোন পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে পেতে তা আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা (নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে) ভেবে দেখে”। (সূরা হাশর: ২১)
আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন,“নিশ্চয়ই আমি একে ( কোরআনকে) কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি। ( হে রাসূল) আপনি কি জানেন, কদরের রাত্রি কি? – কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী / উত্তম।- ফেরেশতারা ও রূহ (জীব্রাঈল আ) এই রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত” ( সূরা কদর: ১-৫)।
সম্মানিত রোজাদার বন্ধু গণ! আল্লাহ তায়ালা এই কোরআন যে মাসে নাযিল করেছেন, সেই মাস আমাদের নিকট সম্মানিত, যে দিন নাযিল করেছেন সে দিন হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। সুতরাং যদি আমরা এই কোরআনের আলোকে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারি তবে আমাদের জীবনও হবে সম্মানজনক ও বরকতময়। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“আমি তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা আকড়ে ধরলে তোমরা কখনোই লাঞ্চিত হবেনা। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও রাসূলুল্লাহ সা :এর সুন্নাহ তথা হাদিস”। (মুওয়াত্তা মালেক: ১৬৬১)
উল্লেখিত হাদিসের প্রতি লক্ষ করলে অনুমান করা যায় আমাদের সমাজের আজ মানুষ নির্যাতিত নিষ্পেষিত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমরা কোরআন থেকে দুরে সরে গেছি, কোরআনের হুকুম প্রতিনিয়ত অমান্য করছি। নিজের সুবিধা মত কোরআনের কিছু আয়াত মানছি আবার নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া কোরআনের আয়াতগুলো অমান্য করছি। তাই সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে আমাদের আবার কোরআনের দিকেই ফিরে আসতে হবে। কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্ছ চেষ্টা/ সাধনা চালাতে হবে, করতে হবে।
উপহার নামে যৌতুক প্রথা সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে:
সম্মানিত রোজাদার ভাই-বোন, বন্ধুরা আমরা দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা ও আত্মসংযমের পর যখন ঈদের আনন্দে মেতে উঠি, তখন কখনো কখনো নিজের মনের অজান্তে আমরা সামাজিকতার আড়ালে উপহার, উপটোকন নামে যৌতুক নামক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যাই। মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ীতে কি পরিমান সেমাই-চিনি, পোশাক-আশাক পাঠালো তা নিয়ে চলে আলোচনা-সমালোচনা। নিজেদের ভিতরে চলে গিবত চর্চা। “বৌ” নামক অসহায় মেয়ের উপর চলে কথার ধারালো ছুরি। অনেক সময় এ বিষয়টি শারিরীক নির্যাতনের পর্যায়েও পৌঁছায়। যা আমাদের পরিবারকে বিষিয়ে তুলছে। সুতরাং আসুন সামাজিকতার নামে এই ধরণের যৌতুক বন্ধ করে সবার মাঝে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিই এবং উপহার নামে যৌতুক প্রথা সামাজিকভাবে বয়কট করি।
ঈদের নামে পর্দাহীনতা:
ঈদের উৎসবকে কেন্দ্র করে যে গুনাহটি আমাদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তা হলো পর্দাহীনতা। ঈদে নতুন ‘বৌ’ অথবা অবিবাহিত বোনকে আপনার বন্ধু বান্ধবদের সামনে উপস্থাপনের একটি কুৎসিত রেওয়াজ রয়েছে যার মাধ্যমে মূলত আপনি আপনার স্ত্রী বা বোনকে যিনার দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন। সম্মানিত ভাই, আপনি কি জানেন, আপনার আড়ালে আপনার বন্ধু-বান্ধব আপনার বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে কি মন্তব্য করে? অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমরা ব্যভিচারের ধারে কাছেও যেয়ো না, নি:সন্দেহে এটি হচ্ছে একটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ”(সূরা ইসরা: ৩২)।
তাছাড়া ঈদ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা এবং নানা রঙের অশ্লীল পোষাক যা রমজানের পরে রমজানের শিক্ষাকে একদম সিকে তুলে ফেলে। আমাদের পরিবার ও সমাজে আজ নারীরা যে পোষাক পরিধান করে তা উলঙ্গপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন: “তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান করবে, পূর্বেকার জাহিলিয়াতের যামানার(নারীদের) মত কখনো নিজেদের প্রদর্শনী করে বেড়াবে না”(সূরা আহযাব: ৩৩)।
অন্য আয়াতে নারী ও পুরুষ উভকেই পর্দার ব্যাপারে বিধান নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “(হে রাসূল!) আপনি মুমিন পুরুষদের বলে দিন তারা যেন তাদের চক্ষু (পরনারীদের থেকে) নিচু রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে”(সূরা নূর:৩১)।
অন্য আয়াতে নারীদের পর্দার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,“(হে রাসূল!) আপনি মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিম্নগামী করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাজত করে,তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে বেড়ায়”(সূরা নূর: ৩২)।
আসুন রমজানের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা যেনার মানসিকতা পরিহার করি এবং পরিবার ও সমাজে পর্দার বিধান কায়েম করার চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।।
লেখকঃগাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ বিশ্লেষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও চেয়ারম্যান -গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।
#